পর্ব ১ - Part 1
অফিসের থেকে বেশ কয়েকদিনের ছুটি নিয়ে অনিমেষ এসেছে নিজের বন্ধু প্রীতমের গ্রামের বাড়ি. প্রীতম আর অনিমেষ সেই হোস্টেলের থেকে বন্ধু. যদিও কর্মসূত্রে তারা আলাদা কাজ করে কিন্তু যোগাযোগ পুরো মাত্রায় ছিল দুজনের মধ্যে. অনিমেষ শহুরে ছেলে, শহরেই তার জন্ম কিন্তু প্রীতম গাঁয়ের ছেলে. কলকাতায় পড়াশুনা সূত্রে আর কর্ম সূত্রে থাকে. ওর বাবা মা আর বোন গাঁয়েই থাকে. খুব বড়োলোক না হলেও মোটামুটি ভালোই সচ্ছল ওদের পরিবার.হোস্টেলে পড়ার সময় প্রীতম অনেকবার অনিমেষকে ওর গ্রামের কথা বলেছে. অনিমেষের গ্রাম খুব ভালো লাগে. শহরের মতো এত যানবাহন নেই, নেই কোনো দূষণ, চিল্লামিল্লি. শুধুই চারিদিকে সবুজ আর সবুজ আর নীল আকাশ. তাই প্রীতম যেদিন অনিমেষকে জানালো অফিসের থেকে ছুটি নিয়ে সে গ্রামে যাচ্ছে বাবা মায়ের কাছে তখন অনিমেষ এই সুযোগ আর ছাড়তে চায়নি. সেও বন্ধুকে জানায় যে সেও তার সাথে গ্রাম ঘুরতে যেতে চায়. প্রীতম তো শুনে খুব খুশি.
প্রীতম : তোকে আগের বারেও বলেছিলাম চল আমার সাথে তখন এলিনা. এবারে আসবি জেনে খুব ভালো লাগছে. ভাই দেখবি…. আমাদের গ্রামে কত শান্তি, এই শহরের মতো আধুনিকতার ছোঁয়া লাগেনি বলেই গ্রামটা এখনও নিজের আসল রূপটা ধরে রেখেছে.
অনিমেষ : আরে আগের বারে কিকরে যাবো বল? তুই শেষ মুহূর্তে জানিয়েছিলি. ওতো শর্ট নোটিসে কি যাওয়া যায়? তাই এবারে যখন একটু আগেই জানালি তাই ভাবছিলাম অফিসের যে ছুটি গুলো জমে আছে সেগুলো কাজে লাগাই. কয়েকদিন এই দূষণ হাওয়া থেকে মুক্তি নিয়ে আসল হওয়ার স্বাদ নিয়ে আসি.
প্রীতম : আমি শনিবার দুপুরে বেরোচ্ছি. তোর জন্য টিকিট কেটে নিচ্ছি তাহলে. খুব ভালো লাগবে. কয়েকটা দিন দুই বন্ধু আনন্দে কাটাবো. বাবা মাও খুশি হবে তোকে দেখে.
এসে গেলো সেই দিন. বাবা মায়ের থেকে বিদায় নিয়ে অনিমেষ বেরিয়ে পড়লো বন্ধুর সাথে তার গ্রামের উদ্দেশ্যে. যত ট্রেন এগিয়ে যেতে লাগলো ততই যেন শহুরে পরিবেশ হারিয়ে যেতে লাগলো আর সামনে ফুটে উঠতে লাগলো লম্বা লম্বা গাছপালা আর জঙ্গল.
স্টেশনে গাড়িটা যখন থামলো তখন সাড়ে ছটা বাজে. খুব একটা লোক নামলোনা এখানে. ওরা ছাড়া মাত্র ৫, ৬ জন. গাড়ি নিজের হর্ন বাজিয়ে এগিয়ে চললো সম্মুখে. বাইরে এসে ওরা একটা গরুর গাড়ি দেখতে পেলো. প্রীতম সঙ্গে সঙ্গে গাড়ির চালককে এদিকে আসতে বললো.
অনিমেষ : বাবা !! এখানে এখনও গরুর গাড়ি চলে দেখছি.
প্রীতম : তোকে বলেছিলাম না…. এখানে সেই ভাবে শহুরে আধুনিকতার ছাপ পড়েনি. আয়.
গরুর গাড়িতে করে এগিয়ে চললো ওরা. বেশ নিরিবিলি এলাকা. ঠান্ডা হাওয়া দিচ্ছে. ভালোই লাগছে অনিমেষের. অনেকদিন আগে ওর পিসির বাড়িতে বেড়াতে গেছিলো গ্রামে. সেই তখন থেকেই গ্রামের শান্ত পরিবেশ ওর খুব ভালো লাগে. তাছাড়া প্রথমবার গরুর গাড়িতে চেপেও ভালো লাগছে ওর. একটু পরেই শুরু হলো ধান ক্ষেত. দুদিকে ক্ষেত মাঝে রাস্তা দিয়ে এগিয়ে চলেছে ওরা. কালকেই এইসব জায়গার ছবি তুলে নেবো… ভাবলো অনিমেষ. নিজের ক্যামেরাটা সেই জন্যই তো সাথে করে নিয়ে এসেছে ও.
একটা দোতলা বাড়ির সামনে এসে থামলো গাড়িটা. বাড়ির চারপাশে বাড়ি ঘর নেই. তবে কিছুদূরে কয়েকটা ছোট বাড়ি আছে. বাড়িতে বাইরে কোনো আলো নেই কিন্তু ভেতরে আলো জ্বলছে কারণ জানলা দিয়ে আলো বাইরে সামনের ওই বট গাছটায় পড়েছে.
ভাড়া মিটিয়ে প্রীতম বন্ধুকে নিয়ে গেট খুলে ভেতরে ঢুকলো. দরজার কাছে এসে বেল বাজালো. সামান্য পরেই বাইরের আলোচনা জলে উঠলো. দরজা খোলার শব্দ. দরজা খুলে হাসিমুখে যে ভদ্রমহিলা বেরিয়ে এলেন তিনি যে প্রীতমের মা সেটা বুঝতে অসুবিধা হলোনা অনিমেষের. পেছনে একজন ভদ্রলোক. উনি নিশ্চই ওর বাবা. প্রীতম হাসি মুখে প্রণাম করলো মাকে তারপরে বাবাকে. এখানে এখনও সন্তান নিজের বাবা মাকে প্রণাম করে তাহলে. শহরের ছেলে হলে তো আগে মাকে বাবাকে ঠেলে ঘরে ঢুকে সোফায় গা এলিয়ে দিতো.
প্রীতম : মা… তোমাকে অনিমেষের কথা বলেছিলাম… এই সেই অনু. মানে অনিমেষ.
প্রীতমের মা : এসো বাবা…. ভেতরে এসো. তোমার কথা ও কতবার বলেছে. আমি তো ওকে অনেকবার বলেছি তোমায় এখানে নিয়ে আসতে.
অনিমেষ হেসে আগে বন্ধুর মাকে আর বাবাকে প্রণাম করলো তারপরে বললো : আমিও আসার কথা বহুবার ভেবেছি কাকিমা… কিন্তু কখনো পড়াশুনার চাপে আবার কখনো কাজের চাপে আসাই হয়ে ওঠেনি. এবারে যখন একটু কাজের চাপ কম তাই ভাবলাম ঘুরেই আসি ওর সাথে.
প্রীতমের মা : খুব ভালো করেছো বাবা. এসো এসো.
অনিমেষ দেখলো. ছোটোখাটো বাড়ি হলেও বেশ ভালোই. গ্রামের সুন্দর বাড়ি, আধুনিকতার কোনো ছাপ নেই এই বাড়িতে আর না আছে প্রীতমের বাবা মায়ের মধ্যে. ওদের ঘরে নিয়ে গিয়ে বিছানায় বসিয়ে ওর মা ওদের জন্য খাবার আনতে গেলো. ঘরে আগে থেকেই একটি মেয়ে বসে ছিল. ওদের দেখে উঠে দাঁড়ালো. দাদা বলে ছুটে এসে জড়িয়ে ধরলো প্রীতমকে. অনিমেষ বুঝলো এই তাহলে বন্ধুর বোন.
বেশ সুন্দরী. প্রীতম আলাপ করিয়ে দিলো অনিমেষের সাথে ওর বোনকে. একটু পরেই ঘরে ঢুকলো ওর মা হাতে লুচি তরকারি নিয়ে. সত্যি… গ্রামের মানুষদের মধ্যে পবিত্র মনে অতিথি সেবার যে ব্যাপারটা আছে সেটা অনিমেষের খুব ভালো লাগে. প্রীতমের থেকেও অনিমেষের বেশি সেবা হতে লাগলো ওরা. খাওয়া দাওয়ার সাথে গল্প চলতে লাগলো. কিছুক্ষনের মধ্যেই অনিমেষ আপনজন হয়ে গেলো ওদের সাথে.
রাতের খাবার পরে দুই বন্ধু চলে এলো দোতলায়. দোতলায় একটাই বড়ো ঘর. সেখানেই ও থাকে. প্রীতমের মা অনিতা কাকিমা আগে এসেই ঘোরটা গুছিয়ে রেখে গেছে. নতুন চাদর, দুটো মাথার বালিশ আর কোলবালিশ রেখে গেছেন. দুই বন্ধু শুয়ে গল্প করতে করতে বেশ কিছুক্ষন সময় কাটালো. একসময় প্রীতম ঘুমিয়ে পড়লো কিন্তু অনিমেষের ওতো তাড়াতাড়ি ঘুম আসেনা তাই ও সিগারেট ধরিয়ে ঘরের এদিক ওদিক দেখতে লাগলো.
ঘরে বেশ অনেকগুলো ছবি. কয়েকটা প্রীতমের ছোটবেলার আবার কয়েকটা ওর বাবা মায়ের সাথে. আবার কয়েকটা ওর বোনের সাথে. কণিকাকে দেখতে কিন্তু বেশ সুন্দর. অনিমেষ সবসময় ভাবতো গ্রামের ছেলে হয়েও প্রীতমকে এত সুন্দর দেখতে কিকরে? আজ সে ওর মাকে দেখে বুঝলো সেটা কেন. কাকিমা এই বয়সেও খুব সুন্দর দেখতে. ঘরে একটা দেয়ালে প্রীতমের বাবা মায়ের আর ওর একটা ছবি টাঙানো ছিল.
দেখে বোঝাই যাচ্ছে ছবিটা প্রীতমের ছোটবেলার. সাদা কালো একটা ছবি. ছবিতে সবচেয়ে আকর্ষণের ব্যাপার হলো প্রীতমের মায়ের মুখটা. সত্যি প্রীতমের মা কমবয়সে খুবই সুন্দরী ছিলেন. যদিও অনিমেষ শ্রদ্ধার চোখেই ওর মায়ের ছবিটা দেখছিলো কিন্তু একটা জিনিস ও ভালো করে লক্ষ্য করছিলো এই মুখের সাথে প্রীতমের বোনের আজকের মুখের অনেক মিল. যেন এই ফটোটা প্রীতমের মায়ের নয়, ওর বোনেরই. কিন্তু পরোক্ষনেই অনিমেষ ভাবলো এটাতে আবার অবাক হবার কি আছে? মেয়ের মুখ মায়ের মতো হবে সেটাই তো স্বাভাবিক. শুধু একটা ব্যাপার মায়ের মুখের থেকে মেয়ের মুখকে আলাদা করে. সেটা লক্ষ করতে করতে অনিমেষ আর বেশি না ভেবে শুয়ে পড়লো.
চলবে…..